গানকে বেঁচে থাকতে হলে প্রোমোশনটা জরুরি। অন্তত এই পরিস্থিতিতে, যখন ফিল্ম মিউজিক প্রায় সবকিছু গিলে খাচ্ছে। তা সত্ত্বেও কিন্তু ইন্ডিপেন্ডেন্ট মিউজিশিয়ানরা স্বপ্ন দেখতে পারছেন। কারণ, এখন আর কারও তাঁবেতে থাকার দরকার নেই। নিজের প্রোমোশন এখন নিজেই করা যায়। সৌজন্যে ফেসবুক, ইউটিউবের মতো মাধ্যম।
অনেকে ভাবছেন, ফ্রি-তেই দিচ্ছেন। তাহলে আর পেশাদার হওয়া গেল কী করে। যাচ্ছে বই কী! এখান থেকেও দিব্যি রোজগার হচ্ছে তাঁদের। এটাই ট্রেন্ড নতুন। হয়তো এভাবেই বাংলা ইন্ডিপেন্ডেন্ট মিউজিক করিয়েরা, বিশেষ করে বাংলা ব্যান্ডগুলো এগিয়ে যাচ্ছে। রাস্তা কঠিন হলেও আশার আলোটা তো দেখা গিয়েছে।
অনলাইন স্ট্রিমিং
তিমির সম্প্রতি বিশ্বাসের ‘অন্ধ প্রেমিক’ অ্যালবামটি বেশ জনপ্রিয় হয়েছে। ভিডিও মিউজিক তো বটেই, পুরো। প্যাকেজটাও কী করে? ইউটিউবের সৌজন্যে। ‘মিডিয়াম বদলাচ্ছে। যে সময়ে লোকে অরিজিনাল সিডি কেনা বন্ধ করে দিয়েছিল, তখন থেকেই আরেকটা বিকল্পের কথা ভাবা উচিত ছিল। ক্যাসেট, সিডি’র পর এল পেনড্রাইভের যুগ। এখন সেটাও নেই, এসে পড়েছে অনলাইন স্ট্রিমিংয়ের যুগ। কেউ মোবাইলে গানই রাখছে না। কাজেই সময় অনুযায়ী চলতে হবে। যে টাকা গান একটা বানাতে লাগে, তার অর্ধেক টাকায় একটা গান অনেক বেশি লোকের কাছে এখন পৌঁছে দেওয়া যাচ্ছে ইউটিউব বা হোয়াট্সঅ্যাপে,’ বললেন তিমির। জানালেন, তাঁর ব্যান্ড ‘ফকিরা’ সেভাবেই এগোচ্ছে দিব্যি!
বাইট করো
প্রোমোশনের চমকটা যে জরুরি, মেনে নিচ্ছেন তিমির। তাঁর অ্যালবাম তিনি প্রোমোট করেছিলেন সেলিব্রিটিদের বাইট দিয়ে। তাতে লাভ? লাভ অনেক! অনলাইনে প্রোমোশন খরচ করে প্রায় কমিয়ে ‘না’-এর কাছাকাছি নিয়ে আসা এবং প্রচুর মানুষের কাছে পৌঁছনো। বলছিলেন, ‘আমার মনে হয়, পঞ্চাশ বছর পর কেউ টিভিই দেখবে না! সকলেই ইউটিউব। দেখবে অনলাইনটাই যখন ভবিষ্যত্, সেদিকেই তাহলে ভাবাটা ভাল। ‘অন্ধ প্রেমিক জন্য’এর টার্গেটই ছিল, পুরো প্রোমোশনটা ফেসবুকে করব। কলকাতায় চারটে হোর্ডিং লাগানোর পিছনে যা খরচ হতো, তার প্রায় অর্ধেকেরও অর্ধেক খরচ করে দু’তিন লক্ষ মানুষের কাছে পৌঁছে যাচ্ছি। আরেকটা মার্কেটিং স্ট্র্যাটেজিও ছিল আমার। সেলিব্রিটি, গানবাজনার সঙ্গে যুক্ত মানুষ কিংবা বিভিন্ন আর্ট ফর্মের সঙ্গে যুক্তদের বাইট নিয়েছিলাম প্রোমোশনের জন্য। আমাদের পর প্রায় সকলেই এটা ফলো করছে। আমরা তো কনট্র্যাক্ট সাইনের ভিডিওটাও দেখিয়েছি। কাজেই একটা বাজ্ তৈরি করা ছিল আগে থেকেই। টেকনিক্যালি বলতে পারি, পাঁচ-দশ শেষ বছরে ‘অন্ধ প্রেমিক’এর মতো ভিডিও হয়নি।’
ফ্রি নয় কিছুই
ফেসবুকে দেওয়া মানেই কিন্তু সবটা ফ্রি-তে হচ্ছে না। সেখান থেকে ইউটিউবেও হিট ভিডিও হচ্ছে, জানালেন তিমির। ‘এই মুহূর্তে অ্যালবাম মানে লাইভ শো’য়ের একটা প্রোফাইল। কাজেই অ্যালবাম ছড়িয়ে যদি যায়, লাইভ শো’য়ের দর বাড়বে। ইউটিউবের ভিউ থেকেও তো আমি পয়সা পাচ্ছি। কোনও না কোনও দিক থেকে ঠিক পুষিয়ে যাচ্ছে কিন্তু,’ বলে দিলেন সাফ। কাজেই বোঝাই যাচ্ছে, যে অনলাইনই আগামী!
রোজগার ভালই
এই মুহূর্তে বেশ কাজ ভাল করছে ‘অ্যান্ড তমাল ট্রিপ’ এবং ‘এলিয়েন্জ’। ইন্ডিপেন্ডেন্ট মিউজিক করছে তারা। দু’টি ব্যান্ডের সঙ্গেই যুক্ত তমালকান্তি হালদার। পুরো বিষয়টাতে লাভ কি হচ্ছে না, সেই প্রসঙ্গে তমাল বললেন, ‘অনেকেই কোমর বেঁধে নেমেছে। সমস্ত প্ল্যাটফর্মগুলোকে মানিটাইজ করছে,
এবং পয়সাকড়িও তুলে নিচ্ছে। বিশেষত ইউটিউব। এক্ষেত্রে নিজের চ্যানেল ইউটিউবে খোলাটা খুব জরুরি। ‘কলকাতা ভিডিওজ’ বলে চ্যানেল একটা হয়েছে। ওরা কিন্তু ভালই রোজগার করছে।’
লিঙ্কটা দিয়ে দিন
ইউটিউব ছাড়া আরেকটা মাধ্যম নতুনদের কাছে খুব কাজের হয়ে দাঁড়িয়েছে। ফেসবুক লাইভ। সরাসরি ফ্রেন্ড লিস্টে থাকা লোকজনেক কাছে নিজের কাজ নিয়ে পৌঁছে যাওয়া সম্ভব হচ্ছে। আদানপ্রদান ভাল-মন্দের হচ্ছে। ‘ওখানে অনেক মানুষের কাছে পৌঁছে যাওয়া যায়। কিন্তু টাকাকড়ি তো আসে না। ফেসবুকে কোনও ভিডিও দিলে এখন দেখবেন, নিজে থেকেই স্ট্রিমিং শুরু হয়। একটু ইন্টারেস্টিং লাগলেই লোকে ক্লিক করে। সে দিক থেকে দেখলে আমাদের কাছে এখনও ফেসবুক লাইভটাই কাজে দিচ্ছে বেশি। কয়েকজনের ভিডিও ছাড়া ইউটিউবে সেই রিচ’টা এখনও নেই। তবে ধীরে ধীরে সেদিকে যাচ্ছে সকলেই। ফেসবুকেই আমরা ইউটিউবের লিঙ্কটাও দিয়ে রাখছি, যাতে ভাল লাগলে সেখানে গিয়ে দেখে,’ বললেন তমাল।
সার্চ মিডিয়াম
বেশিরভাগ মানুষকে শোনানো কিংবা দেখানোটাও কিন্তু এখন সোজা। তবে কনটেন্ট ভাল হতে হবে। ‘আগে যে মাধ্যমগুলোয় ভিডিও যেত দেখানো, সেই মিউজিক চ্যানেলগুলোর সমর্থন তো পাওয়াই যাচ্ছে না। এফএম চ্যানেলগুলো তো প্রায় বলেই দিচ্ছে, ফিল্ম মিউজিক ছাড়া কিছু চালাব না। সেখানে দাঁড়িয়ে ফেসবুক এবং ইউটিউব কিন্তু একটা অল্টারনেটিভ মিডিয়াম এবং প্ল্যাটফর্ম হিসেবে উঠে এসেছে,’ বলছিলেন তমাল।
পেশাদারিত্ব
এই মুহূর্তে পেশাদারিত্বের সঙ্গে কাজ করা মানে কিন্তু ইউটিউবকে লক্ষ্য করেই এগনো। ‘ঠিক করে মার্কেট করতে পারলে সারা পৃথিবীতে আপনার কাজ ছড়িয়ে দেওয়া সম্ভব। তার জন্য আটঘাটগুলোও জানতে হবে। কোনটা টাইম প্রাইম, কখন আপলোড করলে ভিউজ বেশি হবে, অরগ্যানিক বুস্ট কীভাবে বাড়ানো যায়, এসব জানতে হবে। আমি তো আশাবাদী, এভাবে এগোনো যাচ্ছে, ’ বললেন তিনি।
স্টোরিটেলিং
ছাপ ফেলতে কি কোনও স্ট্র্যাটেজি নেওয়া দরকার? ‘এখন তো বম্বার্ডমেন্ট ইনফর্মেশন! ইন্টারনেট খুললেই এতো এতো কনটেন্ট। প্যাকেজ ভাল তো হতে হবেই, কিন্তু শেষমেশ কোয়ালিটিই ম্যাটার করে। আজ না কাল হোক, সেটা স্ট্যান্ড আউট করবে। ভিস্যুয়াল ভাল হলেও অনেকক্ষেত্রেই কিন্তু স্টোরিটেলিংয়ের অভাবটাও লক্ষ্য করছি। কারও নকল যেন মনে না হয়,’ বললেন তমাল।
ডেমো গান
ইন্ডিপেন্ডেন্ট কাজ স্পেসে করছেন ‘রেভোলিউশন ভোকালিস্ট শুভঙ্কর’এর পণ্ডাও। এ প্রসঙ্গে তাঁর মত, ‘লাভ তো হয়ই। এগুলোকে আমরা ডেমো হিসেবে পারি দেখাতে। কোনও কম্পোজারের কাছে গিয়ে বলতে পারি, যে আমাদের এত লোক শুনেছে। আমাদের গানের এতটা জনপ্রিয়তা। আমরা এই ধরনের প্রোডাকশন করি। এগুলো কাজে দারুণ দেয়।’ ইউটিউব-ই যে ভবিষ্যত্, সে কথা মেনে নিচ্ছেন শুভঙ্করও। সম্প্রতি দেবজ্যোতি মিশ্রের সঙ্গে ‘রক্তকরবী’ ছবিতে কাজও করলেন তিনি। ‘জিনিস মাথায় একটা রাখতে হবে, কনটেন্ট ভাল হওয়াটা মাস্ট। না হলে একটা পর্যায়ের পর আর কিছু করা সম্ভব নয়। ফেসবুক লাইভ এখন বেশ জনপ্রিয় হয়েছে। তাছাড়া ফেসবুকে তো পোস্ট করে সেটাকে বুস্ট করার অপশনও রয়েছে। প্রোমোট প্রচুর উপায় করার এখন,’ বললেন তিনি।
এছাড়াও…
ব্যান্ড বাংলা ‘’র পৃথিবী ‘চ্যাপ্টার থ্রি’ অ্যালবামটি ইতিমধ্যেই ৫০ হাজার ইউটিউব ভিউজ ছাড়িয়েছে। রিলিজের মাস খানেকের মধ্যেই। ‘ঈশান’এর অনেক ভিডিওর ৪০ হাজারেরও বেশি ভিউজ। ‘ব্লাড’এর ভিডিওগুলোও ইউটিউবে বেশ জনপ্রিয়। ৩০ হাজারেরও বেশি ভিউ রয়েছে কোনও কোনও গানে। ‘রোড রোলার’ ব্যান্ডটিও নিজের মতো কাজ করছে। ধীরে ধীরে ইউটিউবের মাধ্যমে জনপ্রিয় হচ্ছে তাঁরা। এছাড়াও নতুন গান করতে আসা ব্যান্ডগুলো কিন্তু অনলাইনকেই ভরসা করছে। ফেসবুক তাদের পেজ, অনলাইন আদানপ্রদান দেখলে সেটা বোঝা যায়। বাংলা মিলিয়ে সব ব্যান্ডের ‘হবু’রা অনলাইনেই লাইন দিচ্ছেন।